আমি ব্যক্তিগত ভাবে কোন লেসবিয়ানদের সাথে মিশিনি, আমি নিজে লেসবিয়ান, কিন্তু কেউ যদি আমাকে লেসবিয়ানদের চরিত্র নিয়ে সংজ্ঞা লিখতে বলে, আমি পারব না। আমি কি, তা আমি জানি। আমি মোটেও মানিনা, সবার চরিত্র, চাহিদা সমান হয়। তাই দুম করে কাউকে ট্যাগ করে দেওয়া থেকে যতটা পারি বিরত থাকি। হোমোফোবিকদের কাছ থেকে বহু আক্রমণ আসে। শুনতে শুনতে সয়ে গেছে। তাদের কাছ থেকে আসা আক্রমণ আর খারাপ লাগে না। তারা আক্রমণ করবেই, টিটকিরি মারবেই জানা কথা... ... ...
দেবতাদের মধ্যে সমযৌনতা খুব একটা অপ্রচলিত নয়, যদিও অনেক সময় এগুলি সঙ্গমের চিত্র বহন করে না, বরং আচারে প্রকাশ পায়। অগ্নি অন্য দেবতার বীর্য গ্রহণ করে। যদিও তিনি স্বাহার স্বামী, তিনি সোমের(চাঁদ) সঙ্গে রমণ করেন, কেননা তিনি মুখ দিয়ে পৃথিবীর উৎসর্গ স্বর্গে বসে পান করেন। হিন্দু শাস্ত্র বলে এটি আসলে মিথুন ভঙ্গিমা, যেখানে অগ্নির মুখ যোনির কাজ করে। রামায়ণ আর শৈব পুরাণে যখন পার্বতী আর শিব উপগত হন, তখন দেবতাদের আশঙ্কা হল এই অনন্ত কাল ধরে চলা সঙ্গমে বিশ্বে প্রলয় আসন্ন। এবং তাঁরা বিশ্ব পিতামাতার মিলনে বাধা দান করে। উচ্ছ্রিতদণ্ড রাগান্বিত শিব স্বর্গে উপগত তাঁর অস্খলিত বীর্য কোনও দেবতাকে ধারন করার নির্দেশ দিলে, অগ্নি সেই বীর্য ধারণ করে পান করেন। তবে কথাসরিৎসাগরে বলা হয়েছে শিব অগ্নিকে এটি পান করতে বাধ্য করেন। বেদে মিত্রা আর বরুণের বহু অন্তরঙ্গতার গল্প রয়েছে। ভগবৎপুরাণে এদের দুজনের এক অযোনিসম্ভূত সন্তানের কথা বলা হয়েছে। বরুণের বীর্য বল্মীক স্তুপের ওপর পড়লে বাল্মিকির জন্ম হয়। উর্বশীকে দেখে মিতা এবং বরুণ বীর্য স্খলন করে জলে পড়লে অগস্ত্য আর বশিষ্ঠ্যর জন্ম হয়। ... ...
ছকে বাঁধা জীবনে আমি পারিনি মানাতে। আমি যা চাই, যা পছন্দ করি তা সমাজ পছন্দ করে না। কারণ আমার মন বললেও আমার শরীরের গঠন অনুযায়ী আমার জীবনযাপনের পদ্ধতি সমাজের বাঁধাধরা নিয়মকে আঘাত করে। এক জনের শরীর দেখে তাকে বিচার করা সমাজের কাছে যতটা সহজ, এক জনের অবয়বহীন মানস দেখে তাকে বিচার করা ততটাই কঠিন। আমার শরীরটা একজন নারীর। সমাজ চায় না আমি ছোট করে ছেলেদের মতন চুল রাখি। আমার বিনুনি বাঁধা উচিত। আমি কোন পোশাকে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি তাতে সমাজের কিছু আসে যায় না। আমাকে নিয়মের মধ্যে থাকা উচিত। সমাজ চায় না আমি জিন্স প্যান্ট পরি, আমার পোশাক হওয়া উচিত সালোয়ার আর শাড়ি। সমাজ চায় না আমি সাইকেল-বাইক চালাই, চায় কারুর বাইকের পিছনে আমি বসি। সমাজ চায় না আমি বাড়ির বাইরে বেরোই, কাজ করি। চায় আমি রান্না বান্না আর সন্তান জন্ম দিয়ে তাদের দেখাশুনা করি। চায় না আমি মাঠে ঘাটে গিয়ে খেলাধূলা করি, শরীরচর্চা করি। চায় আমি বাড়ির উঠোনে স্কিপিং করি আর শাহ্রুকের রোমান্টিক ফিল্ম দেখি। চায় না আমি কোন ‘নারী’কে সঙ্গিনী হিসাবে বেছে নি। কারণ শরীরের উপর ভিত্তি করে যে সকল নিয়ম কানুন গড়ে উঠেছে, এ সব কিছু তারই অংশ বিশেষ। মন বা মানসের কোন স্থান এখানে নেই। ছত্তিরিশটা বছর ধরে মোটা কাপড়ের নীচে শরীরটাকে আষ্টেপৃষ্টে ঢাকা দিয়ে বাড়ির বাইরে বার হই, লোকের সাথে মিশি। বাড়ি ফিরে বিবস্ত্র হয়ে আয়নার সামনে যখন দাঁড়াই, কুঁকড়ে যাই। যাঁরা আমাকে চেনেন জানেন তাঁদের কাছে আমি কোন আলোচনার বস্তু না, কিন্তু যাঁরা আমাকে চেনেন না, আমাকে নতুন দেখলেন তাঁরা শুধু আমাকে বিস্ময়সূচক দৃষ্টি নিয়ে আপাদমস্তক পরীক্ষা করে গেলেন। আমি চলে গেলে পিছন থেকে কিছু অস্পষ্ট কথা শুনতে পাই, ‘এটা কে? ছেলে না মেয়ে?’ ... ...
সুপ্রীম কোর্টের রায় নিঃসন্দেহে হতাশ করেছিল কিন্তু তার থেকেও বেশি আঘাত দিয়েছিল সেই রায়ের ভাষা। সে সম্পর্কে অন্যত্র লিখেছি তাই এখানে আর লিখছি না। তবে দুঃখ, কষ্ট হতাশার সঙ্গে যেটা যোগ হয়েছিল, সেটা একটা রাগ, একটা হতাশাজনিত ক্ষোভ। শুধু আমার মধ্যে নয়, আমার মত চারপাশের অনেক মানুষের মধ্যেই দুঃখর থেকেও বেশী ফুটে উঠেছিল রাগ, দেশের প্রতি প্রবল অভিমান। সেই সময় সেই অভিমানের অভিঘাত থেকে একটা লেখা লিখেছিলাম। প্রকাশের অযোগ্য ভাষার কারণে সেই লেখাকে সেই সময় প্রকাশ করা যায় নি। আজ এক বছরের মাথায় সেই লেখাটাকেই একটু কাঁচি চালিয়ে সভ্য করে দিলাম। মনে হল, সেই যে প্রবল রাগের অনুভূতি সেটাও ডকুমেন্টেড হয়ে থাকা দরকার। ... ...
মেয়েটির মায়াময় মুখ এক নিমেষে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। কন্ঠস্বরও। - ওই নেকুপুষুমনু শব্দ অনেকবার শুনেছি স্যার। আমাদের গাড়ির কাছে আসতে দেখলেই কাঁচ উঠিয়ে দিয়ে মিথ্যে ফোনে ব্যস্ত হন সাহেব-মেম, নয়তো কপালে হাত ঠেকিয়ে মাফ করতে বলেন... ফাটা নোট চালিয়ে দিয়ে মনে মনে হাসে লোকে। হলদে, সাদা, লাল – কোন গোলাপই নই স্যার। আমরা হলাম শল্লকী... সারা গায়ে কাঁটা গাঁথা শজারু। নিজের মা সকালে উঠে আমার আর ভাইয়ের মুখ দেখত না। সোজা গোয়াল ঘরে গিয়ে এঁড়ে, বকনা – যা হয় দেখে আসত – এদের কি দোষ। ... ...
যারা ভাবছেন, বিয়ের অধিকার না পাওয়া গেল তো কী এসে গেল, ইকুয়াল ডোমেস্টিক পার্টনারশিপ তো দেওয়াই হচ্ছে, তাদের জন্য একটা ছোট্ট সওয়াল। ধরুন কোন স্কুলে বলা হল, সবাইকে সমান ভাবে পড়ান হবে, একভাবে পরীক্ষা নেওয়া হবে, খাতা দেখা হবে, শুধু খাওয়ার জলের কলটা ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছাত্রছাত্রীদের জন্য আলাদা হবে, মেনে নেবেন? জল একই থাকবে, শুধু কলটাকে সবুজ রঙ করে দেওয়া হবে? জানি আপনি মেনে নেবেন না, কেননা আপনি যদি মেনে নেওয়ার দলের হতেন তা হলে এই লেখাটা এতদূর পড়তেন না। দিনের শেষে সাম্যের অধিকার এক মৌলিক অধিকার, যে অধিকারের প্রশ্নে আপোষ করা চলে না। ... ...
সেখানেও এখন বিধি বাম করে রেখেছেন, ওবামা সাহেব। এখন gay কি homosexuality টাইপ করুন, পাতার পর পাতা জুড়ে এখন তাঁর সমকামী বিবাহকে স্বীকৃতিদানের খবর, আর তাই নিয়ে সমকামীদের হুল্লোড়বাজি । হপ্তা দুই ধরে হট টপিক। আর আরো তো আরো, homosexuality + cure দিয়ে সার্চাতে গেলে আরোই গণ্ডগোল। সমকামীদের ‘অসুখ’সারানো যেত বলে যে স্টাডি দাবি করেছিল, তা কেন ভুল, এসব বলে এতদিন মনোবিদদের পাতার পর পাতার কাউন্টার তো ছিলই, আপনাকে কনফিউজ করার জন্য সবরকম উপকরণ সহ। দুদিন আগে খোদ সেই স্টাডির মূল কত্তাই বোম ফেলেছেন। ক্ষমা চেয়ে। রীতিমতন কান্নাকাটি করে। নিজেই কইছেন, স্টাডি নাকি ভুল ছিল। ক্ষমা চেয়েছেন আলাদা করে সেই সমকামীর কাছেও যিনি নাকি ওই সারানোর থেরাপি নিতে গিয়ে আত্মহত্যা করতে বসেছিলেন। ... ...
আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, এই অসহিষ্ণুতার পেছনে এক পৌরুষ-সাধনার চালচিত্র রয়েছে। মানিয়ে নেওয়া, নরমভাবে সমাধানের পথ খোঁজা, ক্ষেত্র বিশেষে মেনে নেওয়া এইসব মিনমিনে ভাব আমরা সজ্ঞানে বর্জন করেছি। আমাদের সমাজজীবনে আমরা একটা সহজ সমীকরণ করে নিয়েছি, নমনীয়তা ইক্যুয়াল টু মেয়েলি ইক্যুয়াল টু দুর্বলতা। মেয়ে মাত্রই দুর্বল, তাই যা কিছু মেয়েলি তাই পরিত্যাজ্য। আমরা প্রথমে আবেগপ্রবণতা আর চোখের জলকে মেয়েলি বলে দাগিয়ে দিয়েছিলাম, ক্রমে মায়া-মমতা-সহানুভুতি এগুলোও আস্তে আস্তে সেই তালিকায় ঢুকে গেছে। সেই কারনেই আমরা নেতা হিসেবে দেখতে চাই এমন একজনকে যিনি নির্মম, কঠোর, বলদর্পী হয়ত বা হিংস্রও। ... ...
তো বস্টনের গপ্পো বলতে গেলে প্রথমেই যেটা বলতে হবে তা হল আমার অ্যাপার্টমেন্টের কথা। পয়সা বাঁচাতে (থুড়ি সেন্ট বাঁচাতে) আমি একটা পাঁচজনের সঙ্গে শেয়ার করা বাড়ি ভাড়া নিয়েছি। যেহেতু এটা আমার প্রথমবার দেশের বাইরে তাই চেয়েছিলাম একটা মিশ্র সংস্কৃতির বাড়িতে থাকতে। তো ভগবান/জেসাস আমার ইচ্ছে অপূর্ণ রাখেন নি। আমাদের বাড়িতে আমরা দুজন মেয়ে তিনজন ছেলে, তিনজন স্ট্রেট, একজন গে একজন লেসবিয়ান, দুজন কাপল, একজন ভারতীয়, চারজন আমেরিকান, একজন হিন্দু, দুজন খ্রিস্টান, দুজন ইহুদি, আর আমি যাকে আমার সম্ভাব্য বয়ফ্রেন্ড হিসেবে দেখছি সেই পাকিস্তানি মুসলিম ছেলেটিকে ধরলে একেবারে সর্বধর্মসমন্বয়। এবার এই বাক্যটা আরেকবার মন দিয়ে পড়লেই বুঝে যাবেন আমিই আমাদের বাড়ির বস্টনে বং-গে। ... ...
এর মধ্যে বাড়িতে একদিন কয়েকজন বন্ধুবান্ধবকে খেতে ডেকেছিলাম। তার মধ্যে রেখা আর আলিশাও ছিল। ওদের আগেই ফুটফুটে দুটো যমজ হয়েছিল আলিশার গর্ভে, সাম্প্রতিক কালে রেখা অন্তসত্ত্বা। ওরা চলে যাওয়ার পর আমরা চারমূর্তি বসে গল্পগাছা করছিলাম। কথাবার্তা ঘুরতে ঘুরতে গে ম্যারেজ, লেসবিয়ান কাপল, আই ভি এফ, দত্তক ইত্যাদি হয়ে কিভাবে যেন কাটজুতে পৌঁছে গেল। আমি বললাম যে প্রাক্তন বিচারপতি কাটজু মনে করেন, বিয়ের কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্য সন্তান উতপাদন ও প্রতিপালন। তাই যেহেতু গে কাপলদের সন্তান হবে না, তাই গে ম্যারেজ অর্থহীন। আইলীন হঠাৎ রেগে গেল। কাটজুর উদ্দেশ্যে কিছু বাছা বাছা গালাগাল দিয়ে শুতে চলে গেল। খানিকবাদে ড্যানও চলে গেল। আইলীন যদিও তুমুল এলজিবিটি সমর্থক তবু এরকম রেগে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারলাম না। সম্ভবত রেড ওয়াইন একটু বেশি হয়ে গেছে। ওরা দুজন চলে যাওয়ার পর আমি এই কথাটা গণেশকে বলতে ও অবাক হয়ে আমাকে বলল, ও তুমি জান না? আমি বললাম, কী জানব? ... ...
লজিবিটিকিউ দের নিয়ে লিখতে বা বলতে গিয়ে আমরা অবচেতনে অনেক সময়ই কিউ শব্দটা এড়িয়ে যাই। আমরা সমকামীদের নিয়ে লিখি-টিখি, কিন্তু এই কিউ বা কুইয়ার, বাংলা করলে যার প্রতিশব্দ 'উদ্ভট'এর কাছাকাছি, সেটাকে ছুঁই না। কারণ, যে ব্যাপারটা নামেই উদ্ভট, তার মধ্যে ঢোকা কঠিন। কে জানে কী জটিলতায় জড়িয়ে যাব। ওই কারণেই, ঘোষিত ভাবেই যাঁরা কুইয়ার, তাঁদের নিয়ে তেমন লেখাপত্র চোখে পড়েনা। তার চেয়ে কোনো একটা নির্দিষ্ট খোপে ঢুকে থাকা নিরাপদ। সমকামিতা এখনও, সমাজে পুরোপুরি গৃহীত নয়। কিন্তু তবুও সেটা নিয়ে লেখা সহজ, যখন পুরুষ চায় পুরুষকে, অথবা নারী কামনা করে নারীকে -- এরকম এক বোধগম্য সুনির্দিষ্ট খোপ আছে। উভকামিতা বা বিষমকামিতাও তাই। কিন্তু বাকিটুকু তো কেমন তরল, ধোঁয়ায় ঢাকা, যেন পাহাড়ের গায়ের কুয়াশা, যেখানে এদিক-সেদিক থেকে কখন কোন পাইনবন উঁকি মারবে বোঝা দুষ্কর। এ কুয়াশা যেন রহস্যময়। কোনো পাত্রে আঁটানো অসম্ভব। কোনো আকার দেওয়া কঠিন। ... ...
এই গণেশকে সঙ্গে নিয়েই একদিন আমি পৌঁছে গেলাম স্বর্গলোকে, এবার ঠিক সময়ে। মেহফিল তখন সবে জমে উঠেছে। স্বর্গলোক দ্বিতল বিশিষ্ট। উর্ধভাগে গন্ধর্ব-কিন্নরদের নাচ, ভূ-গর্ভস্থ কক্ষে সর্বসাধারণের জন্য নৃত্যাঙ্গন। দেখলাম সেই অনিন্দ্যসুন্দর স্বল্পবসন দিব্যপুরুষদের নাচ দেখার জন্য শুধু আমরা সমকামি পুরুষরাই নই, বহু নারীরাও ভিড় জমিয়েছেন। স্টেজের ওপর নাচের সঙ্গে সঙ্গে বহু ডলারের টিপ্সও হাওয়ায় উড়ে চলেছে। পরে অবশ্য দেখলাম, যা কিছু নোট উড়ে চলছে তার বেশির ভাগটাই এক ডলারের নোট। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ আরো উদ্দাম হতে লাগলো। আমাদেরও তখন অল্প অল্প নেশা হওয়া শুরু হয়েছে। স্টেজ থেকে নেমে এসে একজন দিব্যপুরুষ আমাদের সঙ্গে এসে বসলেন। সাধারনতঃ এই সময়, আধো আলোছায়াতে, একটুকু ছোঁওয়াছুঁয়ির ফাল্গুনি শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু আমার কপাল খারাপ। গণেশ আই আই টি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং করে এসে এম আই টিতে সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র। বামপন্থী চিন্তাধারায় বিশ্বাসী। অতএব ও গে বার ডান্সারদের সমাজতাত্তিক ইতিবৃত্ত জানতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিউটি (দিব্যপুরুষের এই নামই আমি দিয়েছিলাম) খানিকবাদে বিরক্ত হয়ে অন্য টেবিলে উঠে চলে গেল। গণেশ অবশ্য তার আগে ওর হাতে বেশ একটা ভালো টিপস দিয়ে দিল। ... ...
সত্যি কথা বলতে কি, এটাই আমার বস্টনে প্রকৃত কামিং আউট। কেন না আগের দুটো ঘটনাকে কামিং আউট না বলে ক্যাচ আউট আর বোল্ড আউট বললে বোধ হয়, ঠিক বলা হয়। কিন্তু ল্যাবের কামিং আউটটা একেবারে স্টেজে দাঁড়িয়ে, মাইক হাতে নিয়ে ঘোষণা। আর তার সঙ্গে একটা মজার ঘটনা জড়িত, সেটা বুদ্ধদেবকে নিয়ে। বুদ্ধদেব আমার ল্যাবের বাঙালি সহকর্মী। আমার থেকে একটু বড়, বিবাহিত, একটি বেশ মিষ্টি দু বছরের ছোট্ট ছেলে রয়েছে। বুদ্ধদেব দেখলাম দারুণ মিশুকে, প্রথম দিনেই আমাকে বাড়ি নিয়ে চলে গেল, তারপর যা হয়, গপ্পো, আড্ডা, কফি। প্রথম দু-একদিন খারাপ লাগে নি, কিন্তু তারপর বুঝলাম, ওর জীবনের ফিলসফি হল, এই দুনিয়ার সব কিছুই খারাপ। কালোরা খারাপ, মুসলিমরা খারাপ, মিডল ইস্ট খারাপ, মেক্সিকানরা খারাপ, ডেমোক্র্যাট খারাপ, ইন্ডিয়া খারাপ তো বটেই, কলকাতা আরো খারাপ। কিছুদিনের মধ্যেই বুঝলাম, এর সাথে বেশিক্ষণ সময় কাটালে নির্ঘাত ডিপ্রেসড হয়ে যাব। অতএব, বুদ্ধং শরণং থেকে আমাকে পালাতে হবে। কিছুদিন অল্পবিস্তর এড়িয়ে চলার চেষ্টা করলাম, তাতে দেখলাম ও ভারি দুঃখ পেয়ে গেল। কী করি, কী করি ভাবছি, টুরিং পথ দেখালেন। ... ...
এখন আমি কোন কিছু কেয়ার করি না। আমার কর্ম ক্ষেত্রে কিংবা অন্য কিছুতে আমার গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত সঠিক কি না, তা বিচার করবার জন্য অন্য কারুর প্রয়োজন আমি অনুভব করি না। IITতে আমার বন্ধুরা যারা সব সময় আমার যৌনতা নিয়ে প্রকাশ্যে সন্দেহ করত তবুও আমি যাদের বিশ্বাস করতাম, তাদের সবাইকে আমি মেইল করি। তারা আমাকে খুব সাপোর্ট করেছে। এর পর আমি আরও কিছু লোকের সামনে নিজেকে প্রকাশ করলাম, তার পর আরও কিছু লোকের সামনে। আমি খুব মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। কেউ কেউ আমার কথা অবিশ্বাস করেছেন, কেউ বা আমার বক্তব্যকে সম্মান জানিয়েছেন, আমাকে অপমান করেছেন আবার কেউ প্রচণ্ড চমকে গেছেন। হ্যাঁ, IITতে হোমোফোবিক আছে, কিন্তু সব থেকে যেটা প্রয়োজন IITতে অনেক উচ্চমনের ব্যক্তিরা আছেন, তারা আমাকে আশা দিয়েছে। আমি যা ভেবেছিলাম, IIT সেই রকম নয়, কিন্তু সম্পূর্ণ পারফেক্ট বলে কিছু কি পাওয়া যায়? আমি বাস্তব, শেষমেশে ছাত্র সমাজের কণ্ঠ হিসাবে আমার গল্প স্বাধীনতা পেয়েছে। আমি, আমার ক্লাসে কিছু বন্ধুদের পেয়েছি যারা গে-দের ভাল দিক গুলো চিন্তা করে গে হওয়া কতো ভালো তা আমাকে বলে। আমি অনেক প্রোফেসার পেয়েছি যারা আমার কাছে সমকামীদের প্রতি তাঁদের সাপোর্ট প্রকাশ করেছেন। এ সব কিছুর ভিতর দিয়ে আমি দিনের শেষে বিছানায় যাই, জানি আমি এবার নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবো। যদিও আমি অনেক অনুশোচনা, লজ্জা, ডিপ্রেশানের ভিতর দিয়ে গেছি। মেডিক্যাল পরীক্ষা দিয়েছি, আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ছি, সামাজিক বাধানিষেধ পেয়েছি। কিন্তু যখন আমার গল্পটা কতটা ‘প্রেরণাদায়ক’ জানিয়ে আমি আবারও মেইল পাই, তখন আমি অনুভব করি একটা সময় আসবে যখন কোন নতুন সমকামী নিজের প্রকৃত পরিচয় দিতে কখনোই বিব্রত বোধ করবে না, সে কাঁদবে না বরং লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে টিভি সিরিয়ালের কোন নতুন হিরোর উপর তার ক্রাশের কথা সে তার রুম মেট’দের কাছে গল্প করবে। ... ...
কিন্তু এত খাপছাড়া নিত্যনতুন সৃষ্টির সমাহারে বেচারা মানবকূল একেবারে থৈ পায় না। নিজেদের ক্ষুদ্র সীমায়, সীমিত বোধের ছাঁচে সবকিছুকে ফেলে তবে নিশ্চিন্ত বোধ করে। এই অজ্ঞান জাতির বোধে এটুকু কুলোয় না যে, একজন মানুষের সঙ্গে অন্যজনের একটা আঙ্গুলের ছাপও যেখানে মেলে না, সেখানে কোনো একজন গোটা মানুষকে বেশীরভাগের মতো করে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা হীন মুর্খামো ছাড়া আর কিছু নয়। অবশ্য স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাকেই যাঁরা বেঁধে-ছেঁদে ফুল-বাতাসায় নামিয়ে এনে কেবল স্বার্থসিদ্ধির যন্ত্রে পরিণত করেছে, সেখানে তাঁর সামান্য সৃষ্টি আর কত মর্যাদা আশা করতে পারে...! আমরা যাঁরা অন্তরাত্মার আহ্বান শুনে নিয়ম-নিগরের তোয়াক্কা না করে সগর্বে নিজেদের অস্তিত্বের কথা জানান দিই, তাঁরাই এই মানবসভ্যতার কাছে বেখাপ্পা, অদ্ভুতুড়ে, কিম্ভুতকিমাকার এক মুর্তিমান দ্রীঘাংচু। ... ...
আমার নিজের জন্য কষ্ট হয় না। কষ্ট হয় সেইসব লোকদের জন্য, যারা নিজেদের জানা দুনিয়াটুকুর বাইরের কোনো কিছুকে বুঝতেই পারে না। অমুক অমুক লক্ষণ থাকলে ইনি পুরুষ, অমুক অমুক থাকলে ইনি নারী। খুব বেশি হলে উভলিঙ্গ অবধি বোঝা যায় (মেনে নেওয়া অবশ্য চলে না, তবু বোঝা যায়), ব্যস! আমার আয়নার মধ্যে একটা পুরো দুনিয়া আছে যেখানে জেন্ডার, বৃষ্টির পরের নরম আলোর মত অনেকগুলো রং ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতে পারে। আমার এই দুনিয়ায় ভালোবাসার জন্য আমাকে শুধু পুরুষে আবদ্ধ থাকতে হয় না, শুধু নারীতেও না। ভালোবাসা কোমল জলের মত আকার বদলাতে পারে অবিরত। আকৃতি, রূপ, সৌন্দর্য্য। রোদ্দুরের গুঁড়ো আর জলের কণা পলকে এক রং থেকে অন্য রঙে গড়িয়ে যেতে পারে। এই বেগুনি, এই নীল, এই সবুজ, কমলা, লাল। যারা চোখ বন্ধ করে রাখে, অসুবিধা তাদের। তাদের সাদাকালো, সীমাবদ্ধ দুনিয়ার কথা ভাবলে আমার কষ্ট হয়। ... ...
দিল্লী থেকে ফিরে এসেছি অনেকদিন হয়ে গেল। এর মধ্যে আমেরিকায় গে ম্যারেজ লিগাল হয়ে গেছে। সামাজিক সাম্যের লক্ষ্যে একটা বড় পদক্ষেপ। কিন্তু অনেকেই বলছেন যে এটা একটা আপাত সাম্য, হেটেরোনর্মাটিভ সমাজের ছুঁড়ে দেওয়া রুটির টুকরো। অনেকে মনে করছেন, সম্পর্কের বহু রঙ কে অস্বীকার করে এটাও একধরনের চাপিয়ে দেওয়া কপি পেস্ট। আমেরিকার সুপ্রীমকোর্টের রায়ের শেষ অনুচ্ছেদ পড়লে তাদের বক্তব্যকে অস্বীকার করা যাচ্ছে না। ওই রায়ে বলা হচ্ছে, “No union is more profound than marriage, for it embodies the highest ideals of love, fidelity, devotion, sacrifice, and family. In forming a marital union, two people become something greater than once they were.” অর্থাৎ, বিবাহের থেকে গভীর আর কোনো সম্পর্ক নেই। আমার প্রশ্ন, কি করে কোনো তৃতীয় ব্যাক্তি ঠিক করে দিতে পারে কোন সম্পর্কটা প্রোফাউন্ড আর কোনটা নয়? কোন নিক্তিতে মাপা যেতে পারে, সুখের ভালবাসা কার জন্য বেশী গভীর, আমার জন্য না কি তার নতুন প্রেমিকের জন্য? অবয়বহীন ভালবাসার কি গভীরতা মাপা যায়? যারা ভাবতে পারেন “বিয়ের প্রয়োজন যার হয় তার হয়, আমার হয় না”, তাঁদের সম্পর্কের গভীরতা মাপতে যাওয়ার আমরা কে? ... ...
যেখানে সমকামী নিজেই মনে করছেন, তিনি সমকামিতা নিয়ে সুখী নন আর সেই থেকে আসছে অবসাদ, তার আসলি কালপ্রিট নাকি আমাদের সমাজ, যা সকলকেই ভাবতে শেখায় সমকামিতা অসুখ। কারণ, সুস্থ, স্বাভাবিক, সুন্দর, এই তিন স এর সাথে আমাদের সমাজে সমকামিতা যায় না। কারণ, এই সমাজে সমকামিতার গ্রহণযোগ্যতা নেই, স্বীকার করলে পদে পদে হাস্যাস্পদ হতে হয়, লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়। একজন সমকামী তাঁর সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগবেন, এই সমাজে সম্মানের সাথে বাঁচার জন্য পরিবর্তন চাইবেন, মনে করবেন এটা একটি অস্বাভাবিক ব্যাপার, অর্থাৎ তিনি মনে করবেন, তিনি অসুস্থ, এবং নিজের ‘অসুখ’ নিয়ে তিনি অসুখী থাকবেন, তাতে আর আশ্চর্যের কী ! তাই এই ইগো ডিস্টনিক সমকামিতা মানেই অসুখ, তা আদৌ না। চিকিৎসকের নাকি সবার আগে এটি জানিয়ে, বুঝিয়ে কনভিন্স করিয়ে দেওয়া দরকার,সমকামিতার মধ্যে ভুল কিছু নেই। এবং সেই সাথে সবার।যারা অসুখ মনে করছেন, উলটে নাকি তাঁদেরই কাউন্সেলিং দরকার ! ... ...
অব্যর্থ আর অমোঘ শব্দ, শব্দের পর শব্দগুচ্ছ যা জন্ম নিতে পারে কেবল গভীর নৈঃশব্দের মধ্যে আর তাকে রঙে রূপে সাকার করা ছবির পর ছবি। এই যুগলবন্দীর পেছনে যাদের মনন আর শিল্পচেতনা তারা আমার থেকে তো বটেই অনেকের থেকেই অনেক বড় মাপের সৃষ্টিশীল মানুষ, একথা স্বীকারে আমার কোনো লজ্জা নেই। অর্চন মুখার্জির তোলা সব অসাধারণ ফোটোগ্রাফ বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত হয়ে তাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। তা যে এমনি এমনি নয়, নৈশঃব্দের শব্দগুচ্ছে পাতার পর পাতায় তার অকাট্য প্রমাণ। ভাবনা পরিকল্পনাও তার। আর কথা? নিচের উদ্ধৃতি টুকু পড়ুন। তৃতীয় পরিসরের মানুষের গোটা জীবন কতো অল্প কথায়, কী অপরিসীম ব্যঞ্জনায় বিধৃত হয়ে আছে অভিজিত মজুমদারের কলমে !! ... ...
এইসবের মাঝখানে পড়ে আমার ভাবনাচিন্তারা সব কেমন গুলিয়ে যেতে থাকল। মনের মধ্যে প্রশ্ন ওঠা শুরু হল, সত্যিই কি এই বিভিন্ন ধরনের অসাম্যের বিরূদ্ধে আন্দোলন হাত ধরাধরি করে চলতে পারে? কি ভাবে ক্যুইর আন্দোলনে একজন বামপন্থী (মতান্তরে ভাম্প্যান্টি) ও একজন দক্ষিনপন্থীর (মতান্তরে ভক্ত চাড্ডীর) সহাবস্থান হতে পারে? যখন সমকামী আন্দোলনের জন্য কথা বলছি তখন কি আমার অন্য রাজনৈতিক/সামাজিক পরিচয়টাকে সরিয়ে রাখতে হবে? তখন আমার শুধু একমাত্রিক পরিচয়, আমি একজন সমকামি? কিন্ত তাহলে, যে ঘেটোর বিরুদ্ধে এই আন্দোলন, সে গন্ডীই কি নিজের চারিদিকে টেনে নিচ্ছি না আমি? আবার লিঙ্গ-আন্দোলনকে যদি ডান-বামে ভাগ করি, তাহলে কি শক্তিক্ষয় করছি না নিজেদের? "মিনিস্কিয়ুল মাইনরিটি" কি আরো ছোট হয়ে যাচ্ছে না? যদি দেখি ক্যুইর ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে শোভা পাচ্ছে স্পন্সর অনুপম খেরের কাট আউট, যিনি আমার মতে জে এন ইউ ইস্যুতে বাকস্বাধীনতার কন্ঠরোধ করতে চেয়েছিলেন, তখন কি করব? যেহেতু ক্যুইর ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল তাই তার সঙ্গে থাকব, না কি সরে আসব, আর না কি অপছন্দটাকে যথাস্থানেভ্য জানিয়ে রেখে চুপচাপ বসে যাব? আর না কি সন্ত টেরেসার মত বলব, টাকায় কোনও দাগ নেই? টাকা কোথা থেকে এল গুরুত্বপূর্ণ নয়, কি কাজে খরচ হল সেটাই আসল? ... ...